০৩:১৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এক যুগ পর জামায়াতের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন: সরকার পতনের পর পাল্টে গেল আদালতের রায়!”

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৬:০০:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫
  • ১০২২ Time View

 

মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক যুগ পর নাটকীয় পরিবর্তন। ২০২৪ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে আবারও বৈধতা ফিরে পেল বিতর্কিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি।

দীর্ঘ ১১ বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষে দলের নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে জামায়াতের সামনে পুনরায় দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার দ্বার উন্মুক্ত হলো। এই রায়কে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তেমনি শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক—এই রায় কি শুধুই আইনি, নাকি এর পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক বাস্তবতা?

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৩ সালে হাইকোর্টের এক রায়ে জামায়াতের রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল করা হয়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের করা আপিল এক দশক ধরে ঝুলে ছিল। অবশেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চ ২০২৫ সালের রায় দিয়ে বলেছে, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের হাইকোর্টের রায় আর কার্যকর থাকছে না। এখন নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নতুন করে দলটির নিবন্ধন ও প্রতীক বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবে।

এই রায়ের পর জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “দীর্ঘ এক যুগের আইনি লড়াইয়ের সফল অবসান হল। জামায়াতে ইসলামি আবার দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসলো। এটা দেশের আইনি ইতিহাসে এক বড় ঘটনা।”

এই রায়ের ফলে জামায়াতে ইসলামি এখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের পুরনো প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে অংশ নিতে পারবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান এই রায়ের জন্য আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানান এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে দ্রুত নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন।

জামায়াতের রাজনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত বিতর্কিত। পাকিস্তানপন্থী দল হিসেবে ১৯৭১ সালে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে দলটি। স্বাধীনতার পর দলটি নিষিদ্ধ করা হয়। জিয়াউর রহমানের আমলে তারা রাজনীতিতে ফিরে আসে। এরপর একাধিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন করে সরকারে অংশ নেয়।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা বিচারের মুখোমুখি হন। গোলাম আযম থেকে শুরু করে আলী আহসান মোজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। সেই সময় জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন হয়, এবং ২০১৩ সালে হাই কোর্ট দলটির নিবন্ধন বাতিল করে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: সময়ের প্রভাব নাকি বিচারিক স্বাধীনতা?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই রায় নিছক বিচারিক সিদ্ধান্ত না হয়ে বরং সময়, ক্ষমতার পালাবদল ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের অংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। জামায়াতের ফিরিয়ে আসা তারই এক বহিঃপ্রকাশ।

অনেকেই মনে করছেন, নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এবং বিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের সম্প্রসারণের জন্য জামায়াতের মতো ধর্মভিত্তিক একটি দলের প্রয়োজনীয়তা আবার সামনে চলে এসেছে। ফলে আদালতের এই রায় সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত হতে পারে—যা ভবিষ্যতের নির্বাচনকে নতুন মাত্রা দিতে পারে।

মানবাধিকার সংগঠন এবং যুদ্ধাপরাধবিষয়ক গবেষকেরা এই সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, একটি দল যার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ছিল এবং যার শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, সেই দলের রাজনৈতিক পুনর্বাসন ইতিহাস, নৈতিকতা এবং শহীদদের আত্মত্যাগের সঙ্গে বেইমানি।

তারা প্রশ্ন তুলছেন—এই রায় কি এক নতুন রাজনীতির সূচনা, নাকি একটি বিতর্কিত ইতিহাসের গোপন পুনরাবৃত্তি?

সম্পাদক : আলেমা আফরোজা খাতুন
বার্তা সম্পাদক ও প্রকাশক : মোছাঃ সমাপ্তি আক্তার

যোগাযোগ: ভূরুঙ্গামারী , কুড়িগ্রাম
মোবাইল: 01719-417006 / 01714-625816

© 2025 দৈনিক বাংলার জনপদ। সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

About Author Information

Popular Post

বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টি “ভুরুঙ্গামারী উপজেলা” কমিটির অনুমোদন, আহবায়ক মো: আবুল কালাম আজাদ ক্যাপ্টেন ও সদস্য সচিব মোঃ আব্দুল মোতালেব

এক যুগ পর জামায়াতের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন: সরকার পতনের পর পাল্টে গেল আদালতের রায়!”

Update Time : ০৬:০০:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫

 

মোঃ শাহজাহান বাশার, স্টাফ রিপোর্টার

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক যুগ পর নাটকীয় পরিবর্তন। ২০২৪ সালের ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে আবারও বৈধতা ফিরে পেল বিতর্কিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি।

দীর্ঘ ১১ বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষে দলের নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে জামায়াতের সামনে পুনরায় দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার দ্বার উন্মুক্ত হলো। এই রায়কে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তেমনি শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক—এই রায় কি শুধুই আইনি, নাকি এর পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক বাস্তবতা?

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৩ সালে হাইকোর্টের এক রায়ে জামায়াতের রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল করা হয়। সেই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের করা আপিল এক দশক ধরে ঝুলে ছিল। অবশেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চ ২০২৫ সালের রায় দিয়ে বলেছে, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের হাইকোর্টের রায় আর কার্যকর থাকছে না। এখন নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নতুন করে দলটির নিবন্ধন ও প্রতীক বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবে।

এই রায়ের পর জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “দীর্ঘ এক যুগের আইনি লড়াইয়ের সফল অবসান হল। জামায়াতে ইসলামি আবার দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসলো। এটা দেশের আইনি ইতিহাসে এক বড় ঘটনা।”

এই রায়ের ফলে জামায়াতে ইসলামি এখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের পুরনো প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে অংশ নিতে পারবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান এই রায়ের জন্য আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানান এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে দ্রুত নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন।

জামায়াতের রাজনৈতিক ইতিহাস অত্যন্ত বিতর্কিত। পাকিস্তানপন্থী দল হিসেবে ১৯৭১ সালে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে দলটি। স্বাধীনতার পর দলটি নিষিদ্ধ করা হয়। জিয়াউর রহমানের আমলে তারা রাজনীতিতে ফিরে আসে। এরপর একাধিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন করে সরকারে অংশ নেয়।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে জামায়াতের শীর্ষ নেতারা বিচারের মুখোমুখি হন। গোলাম আযম থেকে শুরু করে আলী আহসান মোজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, দেলোয়ার হোসেন সাঈদীসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। সেই সময় জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন হয়, এবং ২০১৩ সালে হাই কোর্ট দলটির নিবন্ধন বাতিল করে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: সময়ের প্রভাব নাকি বিচারিক স্বাধীনতা?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই রায় নিছক বিচারিক সিদ্ধান্ত না হয়ে বরং সময়, ক্ষমতার পালাবদল ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের অংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। জামায়াতের ফিরিয়ে আসা তারই এক বহিঃপ্রকাশ।

অনেকেই মনে করছেন, নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এবং বিরোধী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের সম্প্রসারণের জন্য জামায়াতের মতো ধর্মভিত্তিক একটি দলের প্রয়োজনীয়তা আবার সামনে চলে এসেছে। ফলে আদালতের এই রায় সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত হতে পারে—যা ভবিষ্যতের নির্বাচনকে নতুন মাত্রা দিতে পারে।

মানবাধিকার সংগঠন এবং যুদ্ধাপরাধবিষয়ক গবেষকেরা এই সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, একটি দল যার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ছিল এবং যার শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, সেই দলের রাজনৈতিক পুনর্বাসন ইতিহাস, নৈতিকতা এবং শহীদদের আত্মত্যাগের সঙ্গে বেইমানি।

তারা প্রশ্ন তুলছেন—এই রায় কি এক নতুন রাজনীতির সূচনা, নাকি একটি বিতর্কিত ইতিহাসের গোপন পুনরাবৃত্তি?