স্টাফ রিপোর্টার: মোঃ শাহজাহান বাশার
গত ৫ আগস্টের ‘গণঅভ্যুত্থান’ বাংলাদেশ রাজনীতির ইতিহাসে এক অপ্রত্যাশিত মোড় এনে দিয়েছে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেলে রাষ্ট্রক্ষমতা হঠাৎই ফাঁকা হয়ে পড়ে। শুরু হয় ছাত্রদের বিক্ষোভ, লুটপাট এবং একের পর এক আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আত্মগোপন। এই পরিস্থিতিতে ওবায়দুল কাদের নিজে স্ত্রীসহ বাথরুমে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লুকিয়ে থেকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন ভারতের এক শীর্ষ গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ওয়াল-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর অমল সরকার-কে দেওয়া বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে বলেন, “৫ আগস্ট সন্ধ্যায় আমি এমন এক বাসায় আশ্রয় নিই, যেখানে ভাবিনি কেউ খুঁজে পাবে। কিন্তু হঠাৎই দেখি জনতা সেই বাসায় ঢুকে পড়েছে। তারা শুরু করে ভাঙচুর ও লুটপাট। আমি তখন আমার স্ত্রীসহ বাথরুমে লুকিয়ে পড়ি। প্রায় ৫ ঘণ্টা আমরা সেখানে ছিলাম।”
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, “আমার স্ত্রী বারবার বলছিলেন—আমি অসুস্থ, দয়া করে বাথরুমে আসবেন না। কিন্তু এক সময় জনতা বাথরুমে ঢুকে পড়ে, এমনকি কমোড, বেসিনও লুট করে নিয়ে যায়।”
তিনি বলেন, “এরা আমার দিকে তাকিয়ে বলল—নেত্রী চলে গেলেন, আপনি গেলেন না কেন? তখন তারা আমার ছবি তুলতে চাইল। হঠাৎ তারা শান্ত হয়ে গেল। সেলফি তুললো, কিছু কথা বললো। কেউ বলছিল সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেবে, কেউ বলছিল জনতার হাতে। শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে একটি কালো শার্ট পরিয়ে, মুখে মাস্ক দিয়ে এক ইজিবাইকে করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়।”
এই ঘটনাকে ‘লুটপাটের অভ্যুত্থান’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে কাদের বলেন, “এটা কোনো কৌশলী রাজনৈতিক বিপ্লব ছিল না। বরং এটা ছিল একটা লুম্পেনদের লুটপাটের উত্থান। গণভবনের আশেপাশের এলাকা থেকে মিছিল ছড়িয়ে পড়ে সংসদ এলাকাতেও।”
তিনি আরও দাবি করেন, “এটা ষড়যন্ত্রমূলক ছাত্র-উত্থান ছিল। আমি ভাগ্যবান—সে রাতে বেঁচে গিয়েছি। মৃত্যু তখন আমার খুব কাছে ছিল।”
ওবায়দুল কাদের বলেন, “পরবর্তী তিন মাস আমি বাংলাদেশেই ছিলাম। চেষ্টা করেছি গার্মেন্টস শ্রমিকদের, বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু একটা সংগঠিত করতে। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একে একে সবাই গ্রেপ্তার হতে থাকেন। আমার বিরুদ্ধেও ২০০টির বেশি খুনের মামলা হয়ে যায়।”
“শেষমেশ অনেক অনুরোধ ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি দেশত্যাগ করি। ১৯৭৫ সালের জেলহত্যার পর যেমন কলকাতায় এসে ৯ মাস কাটিয়েছিলাম, এবারও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে,” যোগ করেন কাদের।
ওবায়দুল কাদের সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, যেসব যুবক তাকে বাঁচিয়েছিল তারা আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন না। তিনি বলেন, “যদি হতো, আমি চিনতাম। কিন্তু তারা ছিল ভিন্ন। তারা আমাকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এটা ছিল অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্য। আমার জীবন তখন কয়েক সেকেন্ডের উপর নির্ভর করছিল।”
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান যে আওয়ামী লীগের জন্য ছিল একটি চূড়ান্ত ধাক্কা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শেখ হাসিনার দেশত্যাগ, দলের শীর্ষ নেতাদের আত্মগোপন, লুটপাট, জনরোষ, ছাত্র-জনতার রাস্তায় নেমে আসা—সবকিছুই একটি যুগের অবসান এবং নতুন শাসন-ব্যবস্থার সূচনার ইঙ্গিত দেয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না, বরং এটি ছিল একটি জনগণের ক্রোধের বিস্ফোরণ। প্রশ্ন এখন একটাই—এই উত্তাল সময়ের পর দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির চালক হবেন কারা?
একজন প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের এই স্বীকারোক্তি ইতিহাসে একটি দুঃসহ অথচ শিক্ষনীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে। একজন ক্ষমতাধর নেতা যখন বাথরুমে স্ত্রীসহ লুকিয়ে জীবন বাঁচান, তখন বোঝা যায়—রাজনৈতিক অবস্থান যতই শক্তিশালী হোক না কেন, জনতার রোষের সামনে কেউই নিরাপদ নন।